গাজায় যুদ্ধবিরতি : ট্রাম্পকে ধন্যবাদ
২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ এএম
অনেক নাটকীয়তার পর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে গত রোববার। ইসরাইল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় এই একতরফা যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধে গাজা কার্যত ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিনষ্ট হয়েছে। নারী-পুরুষ-শিশু মিলে মারা গেছে প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। গণহত্যা ও নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞের এমন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের নজির বিশ্বে বিরল। উদ্ধত ইসরাইলের হত্যা-ধ্বংস বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, ইসলামী বিশ্ব সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অবশেষে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সমঝোতা হয়েছে। তার ভিত্তিতে চুক্তি হয়েছে এবং চুক্তি কার্যকর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপে ৬ সপ্তাহে ৩৩ ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। বিপরীতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে ইসরাইল মুক্তি দেবে তার কারাগার থেকে। এ সময় গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো হবে এবং ইসরাইলি সেনাদের একাংশকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে বাকী জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। গাজায় মাসের পর মাস রক্ত ঝরছিল, বেসামরিক মানুষ নিহত হচ্ছিল- বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তার অবসান চাচ্ছিল। যুদ্ধবিরতিতে তারা খুশি ও সন্তুষ্ট। গাজাবাসী প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধের অবসান প্রত্যাশা করছিল। যুদ্ধবিরতির খবর পেয়েই তাদের রাস্তায় বেরিয়ে এসে আনন্দ-উল্লাস করা থেকে সেটা বুঝা যায়। তারা ইতোমধ্যে গৃহে, ভিটেমাটিতে ফিরতে শুরু করেছে। আতশবাজি ও পটকা ফুটিয়ে, মিষ্টি বিতরণ করে তারা যুদ্ধবিরতি উদযাপন করছে। তাদের জন্য যুদ্ধ ছিল বিভীষিকা, যাতে মৃত্যু এবং ধ্বংস ছিল অবধারিত। এই বিভীষিকা থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দ অপার, যার সঙ্গে অন্য কোনো আনন্দের তুলনা হতে পারে না। গণহত্যা ও পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেও যুদ্ধে জিততে পারেনি ইসরাইল। একজন জিম্মিকেও মুক্ত করতে পারেনি। হামাস এই অগ্রাসন ও যুদ্ধের মোকাবিলায় যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। কোনো কিছুতেই নতি স্বীকার করেনি। বিজয় কার্যত তাদেরই হয়েছে। পরাজয় হয়েছে ইসরাইলের। গত প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি আগ্রাসন ও যুদ্ধের বিপরীতে যে অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে, হয় মৃত্যু নয় স্বাধীনতা- এই প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় থেকেছে, তার কোনো তুলনা হয় না।
যুদ্ধবিরতিতে ফিলিস্তিনিরা আনন্দিত, উল্লাসিত হলেও ইসরাইলে কোনো আনন্দ-উল্লাস তেমন নেই। তবে জিম্মিদের পরিবারে আনন্দের জোয়ার বইছে। ইতোমধ্যে যুদ্ধবিরতিতে নারাজ হয়ে ইসরাইলের তিনজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে থাকলেও যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন বাধ্য হয়ে। এটা তার একটা কৌশলও হতে পারে। যে তিনটি দেশ গাজাযুদ্ধে বিরতি টানার জন্য উদ্যেগী হয়, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। অন্য দুটি দেশ- কাতার ও মিসর। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সবচেয়ে বিশ্বস্থ বন্ধু, অন্ধ সমর্থক। গাজা যুদ্ধেও ইসরাইল অর্থ, অস্ত্রসহ সব রকম সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে। বলা হয়, গাজাযুদ্ধ নামে ইসরাইলের, কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের। সেই যুক্তরাষ্ট্রই যুদ্ধবিরতির অন্যতম উদ্যোক্তা হওয়ায় অনেকে বিস্মিত হতে পারে। কিন্তু সর্প হয়ে দংশন এবং উঝা হয়ে ঝাড়ার নজির যুুক্তরাষ্ট্রের কম নেই। বাইডেন প্রশাসন যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু সফলতা পানি। কিংবা এও বলা যায়, সেভাবে চেষ্টা করেনি। প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাইডেনের একেবারে শেষ দিকে এসে, যুদ্ধবিরতির সমঝোতা হয়েছে, ততদিনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরবর্তী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তুত। বাইডেন তার বিদায়ের আগের দিন এক ভাষণে বলেছেন, ‘আজ গাজায় বন্দুকের শব্দ থেমে গেছে। আমার অংশ নেয়া সবচেয়ে কঠিন আলোচনাগুলোর এটি ছিল একটি।’ পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাইডেন যাই বলুন না কেন, যুদ্ধবিরতির আসল কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। তিনি গাজাযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। দায়িত্ব গ্রহণের আগেই যুদ্ধবিরতির দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত তার দাবি মেনে নিয়েই ইসরাইল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। ট্রাম্পের প্রতিনিধিরা যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আগে থেকেই কাজ করছিলেন। নেতানিয়াহু বুঝতে পারেন, ট্রাম্পের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে ভবিষ্যতে তার জন্য সেটা ভালো ফল বয়ে আনবে না। আগামী অন্তত চার বছর নেতানিয়াহু বা ইসরাইলকে ট্রাম্প বা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করতে হবে। যুদ্ধ অব্যাহত রেখে ট্রাম্পের অসন্তুষ্টি অর্জন করা তার ও ইসরাইলের জন্য সস্থিকর হবে না। বলা যায়, গাজায় যুদ্ধবিরতির মূল হোতা ট্রাম্প। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই। ট্রাম্পের যুদ্ধবিরোধী মনোভাব কারো অজানা নেই। তিনি যেমন গাজা যুদ্ধের ইতি চান, তেমনি অবসান চান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেরও। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা বাড়ানো নয়, বরং কমানোর সম্ভাবনাই রয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা হয়তো অচিরেই আসবে। আর সেটা সম্ভব হবে ট্রাম্পের যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের কারণেই। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ যুদ্ধ ও রক্তপাত চায় না। তারা চায় যুদ্ধমুক্ত শান্তিময় বিশ্ব। সেটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল বিশ্বমানবের।
সন্দেহ নেই, যুদ্ধবিরতির পর গাজাবাসীর সামনে অত্যন্ত কঠিন একটা সময় উপস্থিত হয়েছে। ধ্বংসের ছাপ সর্বত্র। অনেকেই আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্তুতি, বাবা-মা হারিয়েছে। অধিকাংশের ঘরবাড়ি, চালচুলা নেই। আয়ের উপায় নেই। খাদ্য-খাবাবের অভাব প্রকট। ত্রাণের ওপর সবার নির্ভর করতে হবে। দীর্ঘ দুর্ভিক্ষাবস্থায় মানুষের দুর্দশার সীমা নেই। স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে মারাত্মকভাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ ও ইসলামী বিশ্বের দায়িত্ব হলো, ত্রাণ ও পুনর্গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা। ইতোমধ্যে ত্রাণবহর প্রবেশ করেছে। এতদিন অবাধে ত্রাণ যেতে দেয়নি ইসরাইল। এখন ত্রাণ দিতে হবে পর্যাপ্ত ও ব্যাপক হারে। যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, তাদের জন্য দ্রুত বাড়িঘর নির্মাণ করে দিতে হবে। হাসপাতাল ধ্বংস ও বন্ধ হয়েছে প্রায় সব। সেগুলো পুনর্নির্মাণ বা পুনর্গঠিত করে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গাজাকে বসবাস উপযোগী ও নিরাপদ করতে বিপুল অংকের অর্থ যেমন প্রয়োজন, তেমনি এ বিনির্মাণ সময় সাপেক্ষও বটে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রসংস্থা ও দেশকে গাজাবাসীর পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বমানবের এই দাবি এড়িয়ে যাওয়ার কারো সুযোগ নেই। বিশ্বরাষ্ট্রসমূহের প্রধান কাজ ও কর্তব্য হওয়া উচিত, যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল যুদ্ধবিরোধী সংস্থা হিসেবে। শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল এর মূল লক্ষ্য। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, জাতিসংঘ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিবেচনা সামনে রেখে বিশ্বের রাষ্ট্রপরিচালকদের যুদ্ধের বিপক্ষে, শান্তির সপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন ট্রাম্প
ভোটের অধিকার রক্ষায় জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে : সিইসি
অস্ত্র মামলায় মামুন খালাস
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা
ইনু-মেনন-সালমান-আনিসদের রিমান্ড, নতুন করে গ্রেপ্তার মন্ত্রী-এমপিসহ ১৬ জন
দলীয় নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান এবি পার্টির
হত্যা মামলায় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ৫ দিনের রিমান্ডে
হজ ও ওমরাহ যাত্রীদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা
আমদানি মূল্য পরিশোধের সময় বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বকেয়া পরিশোধে জুন পর্যন্ত সময় বাড়লো আদানি
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রত্যাহার ব্রিটিশ এমপিদের
দিল্লি ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে : রিজভী
বেক্সিমকোর ১৬টি কারখানার ছাটাইকৃত শ্রমিকদের চাকরি ফিরে পাওয়ার সিদ্ধান্ত ২৭ জানুয়ারি
যুদ্ধবিরতির কয়েক মিনিট আগেও ইসরায়েলের হামলা গাজায় বিলম্বিত সময়ের মধ্যে নিহত ১৯
আমেরিকার স্বর্ণযুগ শুরু হচ্ছে
প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মাঝে ছাত্রদল নেতার শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ
এবার মেডিকেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উত্তীর্ণদের ফল স্থগিত
চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এলডিপি মহাসচিবের বৈঠক
সরিষাবাড়ী ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে কম্বল বিতরণ